আরাফাত হোসেন (কুমারখালি) কুষ্টিয়া
“যতদিন বাঁচবো ততদিন শিখব ” এটা যে শুধু প্রবাদ বচন নয় সেটিই প্রমান করেছে কুষ্টিয়ার কুমারখালীর চরাইকোল গ্রামের হাতেজান নেছা বয়স্ক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এই বিদ্যালয়ে শিক্ষা গ্রহণকারী প্রত্যেকেই কর্মজীবী এবং বয়স্ক। ঠিক তেমনি একজন শমসের আলী (৪৫) পেশায় একজন ভ্যানচালক। বাল্যকালে অভাব অনটনে স্কুলের গন্ডি পেরোতে না পারলেও মনে ছিলো শেখার তীব্র আকাঙ্ক্ষা। আর সেই আকাঙ্ক্ষা থেকেই ৫৫ বছর পর আজ তিনি হাতেজান নেছা বয়স্ক বিদ্যালয়ের ছাত্র।
সারাদিন ভ্যান চালিয়ে সন্ধ্যার পর বিদ্যালয়ে আসেন শুধু শমসের আলী নয় তার মতো আরও অনেক কর্মজীবী মানুষ সারাদিন বিভিন্ন কাজ শেষে বিদ্যালয়ে আসেন শিক্ষার আলোয় আলোকিত হতে।
প্রতিষ্ঠাতা অ্যাডভোকেট আকমল হোসেন ব্যক্তিগত উদ্যোগে আকমল হোসেন শিক্ষা ও সেবা ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে ৭টি শাখার মাধ্যমে প্রায় সাড়ে তিন শতাধিক বয়স্ক পুরুষ ও মহিলা শিক্ষা গ্রহণ করছে। তার এই ব্যাতিক্রমী উদ্যোগে গ্রামে বয়স্ক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে এরই মাঝে সমাজের বিভিন্ন স্তরে প্রশংসা লাভ করেছেন ।
এরই অংশ হিসেবে সমাজের কর্মজীবী বয়স্কদের নিরক্ষরতা দূরীকরণে এবং অবহেলিত মানুষের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে নির্মাণ করেছেন হাতেজান নেছা বয়স্ক বিদ্যালয়।
বয়স্ক এই বিদ্যালয়ে নিরক্ষর কর্মজীবী এসব মানুষদের বাংলা,ইংরেজি,গণিতের পাশাপাশি ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা সহ কোরআন হাদিস থেকে শেখানো হয়। শিক্ষার আলো থেকে ছিটকে পরা স্বাক্ষর বিহীন মানুষগুলো এখন সংসার সামলিয়ে পড়ালেখা শিখছে হাতেজান নেছা বয়স্ক বিদ্যালয়ের কল্যাণে। শিখেছে দস্তখত সহ প্রয়োজনীয় সব লেখাঝোকা। এখন তারা ক্লাস বই থেকে সবই পারেন।
অংকের গণনা থেকে শুরু করে বাংলার স্বরবর্ণ ,ব্যঞ্জনবর্ণ ইংরেজি এ বি সি ডি সাথে সুরে সুরে উচ্চারিত আরবি হরফ। এরই মধ্যে দৈনন্দিন জীবনে চলতে ফিরতে ছোট,ছোট দোয়া জিকির প্রয়োজন তাও আয়ত্ত্ব করে ফেলেছে বয়স্ক বিদ্যালয়ের বয়োজ্যেষ্ঠে এসব মানুষ গুলো।
এই বিদ্যালয়ে পুরুষদের পাশাপাশি সমানভাবে শিখছে নারীরাও। পুরুষদের জন্য পুরুষ এবং মহিলাদের জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছে মহিলা শিক্ষক।
বয়স্ক বিদ্যালয়ের নিয়মিত ছাত্রী রাবেয়া খাতুন বয়স ৮০’র কোঠায় তবুও শিক্ষার আলোয় নিজেকে আলোকিত করতে প্রতিনিয়ত আসেন হাতেজান নেছা বয়স্ক বিদ্যালয়ে। বয়সের ভারে ঠিকমতো চোখে না দেখলেও কম্পিত কন্ঠে ক্লাসে শিক্ষিকার সাথে ব্ল্যাক বোর্ডের অক্ষরগুলি আয়ত্ত্ব করার নিরন্তর চেষ্টা করেন তিনি।
তিনি বলেন, শেখার প্রচন্ড আগ্রহ ছিল কিন্তু অভাব ছিল শেখানোর মানুষের।এই বিদ্যালয়ের কল্যাণে এখন আমি সাত মাসে অনেক কিছু শিখেছি।
আরেক শিক্ষার্থী জাহানারা বেগম (৬৫) জানান, গরীব ঘরে জন্ম নিয়েছিলাম সময় মত লেখাপড়ার আগ্রহ থাকলেও টাকা পয়সার অভাবে শিখতে পারিনি। আজ এই বয়সে এসে অ্যাডভোকেট আকমল সাহেবের স্কুলে পড়ার সুযোগ হয়েছে। এসব বয়স্ক শিক্ষার্থী পেয়ে খুশি বিদ্যালয়ের শিক্ষক- শিক্ষিকারাও।
শিক্ষিকা নাইমা জান্নাত বলেন ,তাদের এই বয়সে এসে শেখার আগ্রহ দেখে আমি মাঝে মাঝে অবাক হই। কোনদিন ভাবতে পারিনি এমন বয়স্ক মানুষদের শিক্ষা দিব। তারাও আমার পড়ানো বিষয়গুলি মনযোগ দিয়ে শেখার চেষ্টা করে।
হাতেজান নেছা বয়স্ক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মাওলানা মোঃ আব্দুল মালেক জানান, সমাজের নিরক্ষরতা দূরীকরণে অ্যাডভোকেট আকমল স্যারের এমন উদ্যোগ। তিনি বয়স্কদের কথা চিন্তা করে হাতেজান নেছা বয়স্ক বিদ্যালয় নির্মাণ করেছেন। বর্তমানে এখানে প্রায় ৩৫০ জন বয়স্ক ছাত্র-ছাত্রী নিয়মিত ক্লাস করে। কর্মজীবী এবং বয়স্করা যাতে তাদের সংসারের কাজ সামলে নিয়মিত ক্লাস করতে পারে সে জন্যই ( সকাল- বিকেল – সন্ধ্যা) তিন বেলায় ক্লাসের ব্যবস্থা রয়েছে।
বয়স্ক বিদ্যালয়ের পরিচালক অ্যাডভোকেট আকমল হোসেন বলেন, সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের নিরক্ষরতা দূরীকরণে এবং সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষদের দোরগোড়ায় শিক্ষার আলো পৌঁছে দিতেই আমার এমন প্রচেষ্টা । সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা পেলে শুধু কুমারখালী নয় সমগ্র কুষ্টিয়া জুড়ে এধরনের শিক্ষার প্রসার ঘটবে বলে তিনি মনে করেন।
এ বিষয়ে কুমারখালী উপজেলা নির্বাহী অফিসার মাহবুবুল হক এর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন ,বয়স্ক শিক্ষা প্রকল্পে সরকারের আলাদা নজরদারি রয়েছে। একই সাথে গ্রাম পর্যায়ে এমন শিক্ষার আলো যারা ছড়িয়ে দিচ্ছেন তাদেরকেও সাধুবাদ জানান এই কর্মকর্তা। তিনি আরো বলেন, শিক্ষার মানোন্নয়নে আবেদনের সাপেক্ষে বিবেচনায় নিয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্য এবং উপজেলা চেয়ারম্যানের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব দেয়া হবে।
হাতেজান নেছা বয়স্ক বিদ্যালয়ে শুধু বয়স্করা নন অর্থাভাবে স্কুল বঞ্চিত ঝরে পরা শিশুরাও বিনা খরচে পড়ালেখার সুযোগ পাচ্ছে। এছাড়াও সুবিধা বঞ্চিত, অসহায় -পঙ্গু ও বিধবাদের মাঝে মাসিক ভাতা প্রদান করেন প্রতিষ্ঠানটি।