এনামুল হাসান শাহিন, কিশোরগঞ্জ
৫ই আগস্ট আওয়ামীলীগ সরকার পতনের পর সারাদেশে শুরু হয় মূর্তি ও ম্যুরাল অপসারণ অভিযান। তখন ভেঙে ফেলা হয় হোসেনপুর হাসপাতাল চৌরাস্তা মোড়ের শেখ মুজিবুর রহমানের ছবির ম্যুরালটি, সেখানে স্থাপিত হয় কালেমা শাহাদাৎ অঙ্কিত আরবি ক্যালিগ্রাফি তখন নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় জাতির পিতা ইব্রাহিম (আঃ) স্মরণি ও কালেমা শাহাদাৎ চত্বর। সাধারণ জনতা ও ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের সদস্যরা মিলে গঠন করে মার্বেল পাথর অঙ্কিত আরবি ক্যালিগ্রাফিক কালেমা শাহাদাৎ চত্বর।
গত শুক্রবার (৪ই অক্টোবর) জুমার নামাজের পর ২ জন মোটরসাইকেল আরোহী আক্রমণাত্মক অবস্থায় আসে এবং কালেমা শাহাদাৎ ক্যালিগ্রাফি ম্যুরাল ভাঙার জন্য উদ্ধৃত হয়, এবং ভাঙার চেষ্টা করে তারা ব্যর্থ হয়। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায় হাতে ছিল ধারালো অস্ত্র। তারা মুখে কালি মেখে হেলমেট পরিহিত অবস্থায় ছিল। তারা খুবই অল্প সময়ের মধ্যে ভাঙার অপচেষ্টা করে পালিয়ে যায়। সাধারণ জনতা ব্যাপারটি বুঝতে পেরে ধাওয়া করলে তারা দ্রুত সেখান থেকে সরে যায় এবং তাদের সাথে ছিল ধারালো অস্ত্র।
তখন একটি ভিডিও ফুটেজ মুহূর্তের মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে যায়। সেখানে দেখা যায় দুইজন মোটরসাইকেল আরোহী একজন মোটরসাইকেলে ছিল এবং অন্য দুষ্কৃতিকারী (ম্যুরাল) কালেমা শাহাদাত ক্যালিগ্রাফি ভাঙতে উদ্ধৃত হয়। তাদের হাতে ছিল ভারী অস্ত্রসহ চাইনিজ কুড়াল। ভিডিওটি সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়লে এ নিয়ে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। শুক্রবার সন্ধ্যায় হোসেনপুর পৌর এলাকায় প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ করে সাধারণ মুসলিম জনতা। তারা দফায় দফায় বিক্ষোভ করে হযরত ইব্রাহিম আঃ স্মরণি (হাসপাতাল চৌরাস্তা মোড়) কালেমা শাহাদাৎ চত্বরে জড়ো হয়। তারপর সেখানে উপস্থিত হয় মুসলিম জনতা বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের ও সদস্যরা, হোসেনপুর উপজেলা প্রশাসন, পুলিশ বাহিনী ও সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাগণ।
তৌহিদী জনতার পক্ষ থেকে একজন বলেন আপনারা অবগত আছেন, আমাদের জান- আমাদের প্রাণ মুসলিম জাতির পিতা ইব্রাহিম (আঃ) স্মরণে আমরা কালেমা শাহাদাৎ এর ক্যালিগ্রাফি করেছি। আজ দুষ্কৃতিকারী জুমার নামাজের পর তারা এখানে আঘাত করেছে। এরা কারা? এখানে (ম্যুরাল) আঘাত করে নাই আমাদের কলিজায় আঘাত করেছে। এর পেছনে কারা দায়ী এটা আমরা দেখব। আমাদের হোসেনপুর প্রশাসনিক কর্মকর্তা আছেন তাদের কাছে আমাদের দাবি- এই মোড়ের নাম হবে কালেমা শাহাদাৎ মোড়। এই রাস্তার নাম হবে জাতির পিতা ইব্রাহিম (আঃ) স্মরণী। ৯২ ভাগ মুসলমানের দেশে কালিমা শাহাদাতের উপর আক্রমণ এটা মানা হবে না। আমরা হোসেনপুর উপজেলাবাসী ছাত্রসমাজ, যুবসমাজ উলামায়ে কেরাম এই নেক্কার জনক ঘটনার বিচার চাই। আইন আমরা হাতে তুলে নেব না। এখানে সেনাবাহিনী আছেন ইউএনও অফিসার তাদের কাছে আবেদন থাকবে দ্রুত এর বিচার চাই। কারা এই ঘটনার পিছনে দায়ী এটার বিচার আমরা চাই।
হাফেজ কারিমুল্লাহ্ বলেন, এই স্থাপনা করেছেন আমাদের হোসেনপুরের তৌহিদি জনতাসহ ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ও অন্যান্য অঙ্গ সংগঠনের কর্মীরা। এটা আমরা সকলেই জানি- আমরা একটা কথা স্পষ্ট করতে চাই এই ১৬ বছরে যা করা হয়েছে, যদি কেউ চায় নতুন করে আবার দেশটাকে একটা বিভ্রান্তের বেড়া-জালের ভেতর নিয়ে আসবে জ্যান্ত কবর দিয়ে দিব। সুতরাং আমাদের পরিষ্কার বক্তব্য- এই দুঃসাহস বাংলায় কেউ দেখাতে পারবে না আর। আমরা প্রশাসনকে সর্বোচ্চ সম্মানের সাথে বিনয়ের সাথে বলতে চাই- যদি ৭২ ঘন্টার ভেতরে এই দুষ্কৃতিকারীকে আইনের আওতায় না আনা হয়, যে কোন মূল্যে আমরা তাকে জ্যান্ত কবর দিয়ে দেব। আমি আপনাদেরকে শান্ত থাকতে বলব এবং আমরা এখন থেকে এই চত্বরকে জাতির পিতা ইব্রাহিম (আাঃ) স্মরণী হিসেবে উল্লেখ করব।
ইঞ্জিনিয়ার ইয়াসিন আরাফাত বলেনঃ আজকে যে কালেমায়ে শাহাদাতে আঘাত করা হয়েছে। এটা প্রতিটি মুসলমানের কলিজায় আঘাত করা হয়েছে। শুধু হোসেনপুরের মুসলিম নয়, সারা পৃথিবীর মুসলিম উম্মার কলিজে আঘাত করা হয়েছে। ওরা দুইটা উদ্দেশ্য নিয়ে করতে পারে- এক হতে পারে কালেমাকে ভূলুন্ঠিত করা, আরেক হতে পারে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করা। আমরা দুইটা ভিউ পয়েন্ট থেকে বলতে চাই- ওরা আমাদের কালেমাকে মুছে দিতে চেয়েছিল। আমরা আমাদের কালেমাকে আরো জোড়ালো ভাবে প্রতিষ্ঠিত করব। আজকে থেকে এই চত্বরের নাম হবে কালেমা শাহাদাৎ চত্বর। আমাদের উপজেলার ইউএনও মহোদয় প্রাথমিকভাবে একটা প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এই ম্যুরালটি সংস্কার করে নতুন আরেকটা মার্বেল লাগিয়ে দিবে। আমি বলেছি কালিমা তার এই ক্ষত চিহ্ন নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে। ওরা আমাদের বুকে যে ক্ষত এঁকে দিয়েছে, আমরা সে ক্ষত বয়ে বেড়াবো। ঘটনার সময় এখানে যে মুসলিমরা বাধা দিতে পারে নাই, কাপুরুষের মত দাঁড়িয়েছিল- তারা এটা দেখে শিক্ষা নেবে। উপজেলা প্রশাসনকে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে যে, এই চত্বর প্রশাসনিকভাবে কালেমা শাহাদাৎ চত্বর হিসেবে নামকরণ করা হবে। দ্বিতীয় প্রতিশ্রুতি দিতে হবে যে এই রাস্তা এই চত্বর থেকে কুড়িঘাট পর্যন্ত জাতির পিতা ইব্রাহিম (আঃ) স্বরণি হিসেবে নামকরণ করা হবে। উপজেলা প্রশাসন এই দুই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন না করলে আমরা আমাদের বিক্ষোভ বন্ধ করবো না। আমাদের মনে রাখতে হবে, আমরা কারো দাবার গুটি হবো না। ওরা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করতে চেয়েছে আমরা তাদের উস্কানিতে পা দেবো না। উপজেলা প্রশাসন আছেন আমাদের দুই দাবি মেনে নেবেন এবং এই দুই দাবি অনতিবিলম্বে বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিবেন, তবে আমরা আমাদের বিক্ষোভ বন্ধ করবো।
ইঞ্জিনিয়ার ইয়াসিন আরাফাত আরও বলেন, এই চত্বরের নাম হবে কালিমা শাহাদাৎ চত্বর। এই শাহাদাৎ চত্বর থেকে কুড়িঘাট পর্যন্ত এই সড়কের নাম হবে "জাতির পিতা ইব্রাহিম (আঃ) স্মরণী"। ভিডিও ফুটেজ দেখে দোষীকে চিহ্নিত করে গ্রেফতার ও অনতিবিলম্বে তিনি পদক্ষেপ নেবেন।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) অনিন্দ্য মন্ডল বলেন, আজকে হোসেনপুরে যে ঘটনাটি ঘটেছে, এই ঘটনার নিন্দা জ্ঞাপন করছি। সহস্র প্রাণের বিনিময়ে নতুন বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার করছি। হোসেনপুরের সাধারণ জনতা, ছাত্রজনতা সকলকে নিয়ে নতুন বাংলাদেশ গড়বো- এই আমাদের অঙ্গীকার। কিন্তু মাঝে মাঝে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা যখনই ঘটবে, তখনি আমরা একসাথে প্রতিহত করবো- আজকে উপজেলা প্রশাসন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, পুলিশ বাহিনী যৌথভাবে একসাথে এসেছি এটা জানান দেওয়ার জন্য- এরকম দুষ্কৃতি কারীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রসহ সবাই একসাথে কাজ করব। এবং ছাত্র জনতা সামগ্রিক জনসাধারণকে সাথে নিয়ে এরকম নেক্কার জনক ঘটনার প্রতিবাদ ও প্রতিহত করবো। আমরা আজকে যে চেতনাকে ধারণ করি, যদি সম্মিলিতভাবে কাজ করে বাংলাদেশকে যে অদম্য চেতনা আছে, সেই শক্তিতে বলিয়ান হয়ে নতুন বাংলাদেশ গঠন করতে পারব। এখানে তরুণ সমাজেই ভূমিকা পালন করবে সকলকে নিয়ে। এই যে ঘটনাটি ঘটেছে আমরা সুনির্দিষ্ট করে বলতে চাই- যে প্রচলিত আইন আছে, আইনের আলোকে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ এবং যতদূর পর্যন্ত যাওয়া যায় এটা তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমাদের কাছে একাধিক ফুটেজ এসেছে। আমরা ফুটেজ থেকে যতটা জানতে পেরেছি তার মুখে কালিমাখা ছিল এবং বিভিন্ন অস্ত্রসহ এসেছে। ইতোমধ্যে আমরা ভিডিও দেখে প্রমাণ পেয়েছি। এর আলোকে যেকোন টেকনিক্যালি সাপোর্ট থেকে শুরু করে পুলিশ বাহিনীর কাছে যে সমস্ত আধুনিক প্রযুক্তিগুলো আছে, সেগুলোর আলোকে আমরা এই দুষ্কৃতি কারীকে খুঁজে বের করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করব। এবং ইতিমধ্যে জেলা প্রশাসকসহ আমাদের বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর যারা জেলা থেকে যোগদান করেছেন, সকলেই অবহিত হয়েছেন। সবাই একসাথে কাজ করবো আমরা বিশ্বাস করি। অতি সত্বর আমরা এই দুষ্টিকারী কে ফাইন্ড আউট করতে পারবো। এবং দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী তাকে আইনের আওতায় এনে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা হবে। আপনারা দেখেছেন বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনী ইতিমধ্যে তাদের তদন্ত কাজ শুরু করেছে। এবং আমরা সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করেছি যারা ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী তাদের কাছ থেকেও ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। তদন্ত এখন অগ্রসর। আপনারা সকলেই আমাদের সহযোগিতা করেন। আপনাদের ধন্যবাদ জানাতে চাই, আপনারা ঘটনাটি ঘটার পর উপজেলা প্রশাসনকে আগে জানিয়েছেন, বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীকে জানিয়েছেন। এবং আমরা সকলেই মিলে এসেছি, আমি আপনাদের সাথে সহমর্মী। আমরা এ ঘটনাটিতে অত্যন্ত কষ্ট পেয়েছি। আপনাদের প্রতি আমাদের অনুরোধ হচ্ছে- আপনারা যে যতটুকু তথ্য জানেন- সিসিটিভি যেগুলো আছে সেগুলোর ফুটেজ আমাদেরকে দেন, তাহলে আমরা অতি স্বল্প সময়ে ঘটনাটি যারা পরিকল্পনা করে ঘটিয়েছে, তাদেরকে আমরা আইনের আওতায় আনতে পারবো। আমরা দুইটি ফুটেজে দেখেছি সে যথেষ্ট প্রস্তুতি নিয়ে এসেছে। সে মুখে কালি মেখে এসেছে, তার হাতে চাইনিজ কুড়াল দেখা গেছে। উত্তেজিত জনতা তাকে ধাওয়া করেছিল, তার সাথে অস্ত্র থাকায় তাকে পাকরাও করতে পারে নাই। আমাদের প্রশাসন পুলিশ বাহিনীর অনুরোধ হচ্ছে আমাদের তথ্য দিয়ে সহায়তা করুন। এখন আমাদের সম্মিলিত ভাবে সহযোগিতা করুন। এই ঘটনাটি যারা ঘটিয়েছে এর নীল নকশা যারা এঁকেছে তাদের প্রত্যেককে খুঁজে বের করবো।